প্রযুক্তি

Type Here to Get Search Results !

প্রায় ৮৫০ বছর আগেকার

প্রায় ৮৫০ বছর আগেকার কথা। দক্ষিণ ভারতের বিজ্জবিড় নামে এক নগরে বসে করতেন এক ব্রাহ্মণ। নাম ভাস্করাচার্য। অঙ্ক এবং জ্যোতিষ দুটি বিষয়েই ছিল তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য। নগরের সীমানা ছাড়িয়ে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল দূর দেশে। দেশের রাজা মহারাজা থেকে সাধারণ মানুষ সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা করত। এত সম্মান খ্যাতি তবুও মনে সুখ ছিল না ভাস্করাচার্যের। তাঁর একমাত্র সন্তান লীলাবতী রূপে সরস্বতী গুণে লক্ষ্মী। শান্ত ধীর, অসাধারণ মেধাবীI মুখে মুখে পিতার কাছ থেকে শাস্ত্রের নানান পাঠ নিয়েছে৷
এমন গুণবতী, রূপবতী কন্যা তবুও ভাস্করাচার্য নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণায় কষ্ট পান। জন্ম সময়ে তিনি কন্যার ভাগ্য গণনা করে কোষ্ঠী প্রস্তুত করেছেন। তাতে স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে কন্যার বৈধব্যযোগ। এ কথা তিনি ছাড়া আর কেউ জানেন না। এতদিন ভুলেই ছিলেন। কিন্তু এখন যে কন্যা বিবাহযোগ্য হয়ে উঠেছে। প্রতিবেশীরা মেয়ের বিবাহের কথা বলছে। অনেকেই লীলাবতীকে বিবাহ করতে চায়। দিবারাত্র ভাবতে থাকেন ভাস্করাচার্য। কার সাথে তাঁর কন্যার বিবাহ দেবেন? জেনেশুনে একটি ছেলের জীবন নষ্ট করবেন!
এক সময় তাঁর মনে হল গণনায় কোন ভুল হয়নি তো? আরো কয়েকজন গণৎকারকে দিয়ে নতুন করে গণনা করালেন। সকলেই একমত, এই কন্যার বিবাহ দেওয়া উচিত নয়। বিবাহের অল্প দিনের মধ্যেই এর স্বামীর মৃত্যু হবে।
কিন্তু এর কি কোন প্রতিকার নেই? ভাবতে থাকেন ভাস্করাচার্য। সমস্ত পুঁথিপত্র নিয়ে বসলেন । কয়েক দিন ধরে অবিশ্রান্ত গণনা করার পর একটি মাত্র শুভক্ষণ পেলেন। ঐ শুভক্ষণে বিবাহ হলেই একমাত্র কন্যার বৈধব্যযোগ রোধ করা সম্ভব। কন্যার উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান পেতে দেরি হল না। বিবাহের প্রস্তুতি আরম্ভ হল।
বিবাহের শুভদিন এসে গেল। সকাল থেকে ভাস্করাচার্য উদ্বিগ্ন, সেই শুভক্ষণ যেন পার না হয়ে যায়। সময় নির্ধারণ করবার জন্য বালু ঘড়ি বসানো হয়েছে কক্ষের একদিকে৷ বারংবার ভাস্করাচার্য নিজে এসে সময় দেখছেন।
সেই যুগে সময় নির্ধারণের জন্য বালু ঘড়ি ব্যবহার হত। বালু ঘড়িতে দুটি কাঁচের পাত্র উপর-নিচ করে বসান হত। দুটি পাত্রেই একটি করে ছোট ফুটো ছিল। একটি পাত্রে বালি ভর্তি থাকত। তার থেকে ফোঁটা ফোঁটা করে বালি ঝরে পড়ত। নির্দিষ্ট সময়ে পাত্রটি খালি হলে তা আবার উলটো করে দেওয়া হত। আর তার থেকে সময় নির্ধারণ করা হত।
বালু ঘড়ি। লীলাবতী প্রকৃত ব্যাপারটি জানত না। বারংবার কৌতূহলী হয়ে বালু ঘড়ির দিকে গিয়ে দেখছিল। এদিকে পুরোহিত অপেক্ষা করে থাকেন। সময় পার হয়ে যায়। লগ্ন যে আর হয় না। অধৈর্য হয়ে বালু ঘড়ি ভাল করে দেখতেই আর্তনাদ করে উঠলেন ভাস্করাচার্য। লীলাবতী যখন বালু ঘড়ির উপর ঝুঁকে পড়ে সময় দেখছিল তখন তার অজান্তে গলার হার থেকে একটি মুক্তো খসে পড়ে বালি পড়ার ছিদ্রটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাই কখন যে বিয়ের লগ্ন পার হয়ে গিয়েছিল কেউ জানতে পারেনি।
দুঃখে ভেঙে পড়লেন ভাস্করাচার্য। কন্যার বিবাহ হল। বিধির বিধান খণ্ডন করে মানুষের সাধ্য কি! অল্পদিনের মধ্যেই স্বামীকে হারিয়ে পিতার কাছে ফিরে এলেন লীলাবতী। কন্যার জীবনের সব আনন্দ সুখ চিরদিনের জন্য মুছে গেল। তাঁর জীবনের দুঃখ ভোলবার জন্য ভাস্করচার্য কন্যাকে বিদ্যাশিক্ষা দিতে আরম্ভ করলেন। আর সেই জন্য রচনা করলেন গণিত শাস্ত্রের বিশাল এক গ্রন্থ সিদ্ধান্ত শিরোমণি - এই গ্রন্থের মোট চারটি খণ্ড। প্রথম খণ্ডের নাম লীলাবতী- এতে সাধারণ গণিত নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। লীলাবতী পৃথিবীর আদিমতম গণিতের গ্রন্থ। প্রাচীন ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা।
আনুমানিক ১১৫০ খ্রিস্টাব্দে সিদ্ধান্ত শিরোমণি রচিত হয়েছিল। তখন ভাস্করাচার্যের বয়স মাত্র ৩৬। ইউরোপে প্রথম গণিতের বই প্রকাশিত হয়েছিল ১২০২ খ্রিস্টাব্দে। লিওনার্দ দ্য পিসা নামে এক পণ্ডিত এই বই রচনা করেছিলেন।
আনুমানিক ১১১৪ খ্রিস্টাব্দে দাক্ষিণাত্যের বিজ্জবিড় গ্রামে ভাস্করাচার্যের জন্ম হয় । তাঁর জীবন কাহিনী সম্বন্ধে যতটুকু জানা যায় তার কতটুকু সত্য কতটুকু কল্পনা তা বিচার করা কঠিন। তবে সাম্প্রতিক কালে বোম্বাই- এর অন্তগর্ত চালিসগাও নামে একটি স্থান থেকে কয়েক মাইল দূরে একটি পুরনো মন্দিরের শিলালিপি থেকে জানা যায় ভাস্করাচার্যের পিতার নাম ছিল মহেশ দৈবজ্ঞ; তাঁর পিতার নাম মনোরথ; তাঁর ঊর্ধ্বতন পুরুষদের নাম যথাক্রমে প্রভাকর, গোবিন্দ, ভাস্করভট্ট এবং ত্রিবিক্রম। ভাস্করাচার্যের দুই পুত্রের নাম জানা যায়- লক্ষ্মীধর ও চঙ্গদেব। এঁরা সকলেই ছিলেন শাস্ত্রজ্ঞ। পাণ্ডিত্যের জন্য তাঁরা ছিলেন সকলের শ্রদ্ধেয়। শিলালিপিতে প্রত্যেকের সম্বন্ধেই রয়েছে প্রশস্তি। তবে ভাস্করাচার্যের প্রশংসায় মুখরিত হয়ে উঠেছে লিপিকার। তাঁকে বলা হয়েছে ভট্ট পারদর্শী তিনি সাংখ্য, তন্ত্র, বেদে মহাপণ্ডিত। তাঁর তুল্য জ্ঞান আর কারো নেই। কাব্যে, কবিতায়, ছন্দে, অতুলনীয়। গণিতে শিবের মতই তিনি মহাজ্ঞানী, তাঁর চরণে প্রণাম জানাই।
এই লিপিতে কোথাও লীলাবতীর উল্লেখ নেই। তাহলে লীলাবতীর অস্তিত্ব কি শুধুই কাল্পনিক! এই বিষয়ে নানা রকম মত আছে। অনেকের ধারণা লীলাবতী ছিলেন ভাস্করাচার্যের কন্যা। তিনি অত্যন্ত বিদূষী ছিলেন। লীলাবতী অংশটি তাঁরই রচিত। ভাস্করাচার্য সমগ্র সিদ্ধান্ত শিরোমণি গ্রন্থটি কন্যাকে উৎসর্গ করেছিলেন। কেউ বলেল লীলাবতী নামে কোন নারীরই অস্তিত্ব নেই। কারণ এই বইটির বিভিন্ন শ্লোকে কোথাও সখে, কোথাও প্রিয়ে চঞ্চলা ইত্যাদি সম্বোধন করেছেন। কন্যাকে কেউই প্রিয়ে বা সখে বলে সম্বোধন করে না। সম্ভবত ভাস্করাচার্য জ্ঞানের দেবী সরস্বতীকেই বিভিন্ন সম্বোধনে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করেছেন। লীলাবতী প্রসঙ্গে যতই বিতর্ক থাক, মূল পুস্তকখানি নিয়ে কোন বিতর্ক নেই। এর প্রথম খণ্ড লীলাবতীতে সাধারণ গণিত নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এর প্রথমে রয়েছে গণেশ বন্দনা আর মঙ্গলাচারণ। লীলাবতীতে মোট ২৭৮ টি শ্লোক আছে। এতে সরল গণিতের বিভিন্ন পদ্ধতি সহজভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। সাধারণ যোগ, ঘনমূল, অনুপাত, সমানুপাত, বিপরীত ক্রিয়া, সুদকষা, ভগ্নাংশ, লাভক্ষতি।
গণিত ছাড়াও লীলাবতীতে জ্যামিতি নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন। এতে আছে ত্রিভুজ চতুর্ভুজ ট্রাপিজিয়ম বৃত্ত। প্রতিটি বিষয়েই তাঁর আলোচনা মোটামুটি নির্ভুল। লীলাবতী থেকে একটি অঙ্কের উল্লেখ করা হল। “একজন ব্যক্তি কিছু অর্থ নিয়ে তীর্থযাত্রা করেছিল। তাঁর মোট সঞ্চিত অর্থের অর্ধেক প্রয়োগে ব্যয় করল। অবশিষ্ট অর্থের দুই নরমাংশ কাশীতে ব্যয় করল। পথখরচ বাবদ তার ব্যয় হল অবশিষ্টের এক চতুর্থাংশ। অবশিষ্টের ছয় দশমাংশ ব্যয় হল গাঁজাতে। তীর্থযাত্রীর হাতে অবশিষ্ট রইল মাত্র ৬৩ টি মুদ্রা।” ভাস্করাচার্য প্রশ্ন রেখেছেন তীর্থযাত্রীটি কত মুদ্রা নিয়ে পথে বার হয়েছিল।
Tags

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.